সমাজ উন্নয়নে অনন্য অবদান রাখছে জকিগঞ্জ সোনার বাংলা সমিতি


এখলাছুর রহমান: পৃথিবীর কোন ক্ষুদ্র জিনিসকেই অবহেলা করা ঠিক নয়। ক্ষুদ্র থেকেই বৃহতের সৃষ্টি। এমন প্রতিপাদ্য নিয়ে বেকারত্ব দূরীকরনে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে জকিগঞ্জের সোনার বাংলা বহুমূখী সমবায় সমিতি। এ সমিতির ভাবনা ও যাত্রা নিয়ে সম্প্রতি সময়ে এমডি জাফরুল ইসলামের সাথে কথা হয়। তিনি তখন সমবায় সমিতির যাত্রা শুরু নিয়ে বলেন, প্রতিদিনের অল্প সঞ্চয়, একদিন বড় পুঁজি। ২০০৭ সাল। যৌবন তখন শুরু। ৬ ভাইবোনের মধ্যে আমি ৩য়। বাবা ব্যবসায়ী। এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেরা ডিগ্রি পাস করে বেকার বসে আছেন। চাকরি খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। এসব দেখে আমি কর্মসংস্থানের জন্য চিন্তা শুরু করে দিলাম। কিন্তু কর্মসংস্থান খুঁজতে গিয়ে চোখ অন্ধকার। ভাবতে থাকি কী করা যায়।
২০০৭ সালের ওই সময়টা সারা দেশ বন্যায় প্লাবিত। জকিগঞ্জও তখন বন্যার পানিতে থইথই করছে। বাড়ির পাশেই পাউবোর বেড়িবাঁধ। একদিন ঘর থেকে বের হয়ে একা বসে ভাবছি নিজেকে নিয়ে। কী করব? কোথায় যাব? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো, একটা সমিতি করি।
যেই ভাবনা, সেই কাজ। এলাকার ২০ জন তরুণকে নিয়ে একদিন বসে পড়লাম বৈঠকে। সেখানে ‘জকিগঞ্জ সোনার বাংলা বহুমূখী সমবায় সমিতি’ নামে একটি সমিতি গড়ার প্রস্তাব উঠল। এতে সদস্যরা প্রতিদিন ১০ টাকা থেকে শুরু করে হাজারো টাকা পর্যন্ত জমা দেবেন। যেমন কথা, তেমন কাজ। শুরুতেই আমি সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পেলাম। পরের দুই মাসের মধ্যে সমিতির সদস্য ৬০ জনে এসে দাঁড়াল। সদস্যদের মধ্যে বেশী ব্যবসায়ী সমাজ। সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি এটিকে নিবন্ধন করার সিদ্ধান্ত নিল।
এভাবে এক বছর পর সমিতির মূলধন হিসেবে তহবিলে জমা হলো প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা। এবার ওই টাকা দিয়ে আরম্ভ করলাম ঋণদান কার্যক্রম। যেমন এলাকার একজন রিকশাচালক ভাড়ায় রিকশা চালাতেন। তাঁকে ডেকে এনে রিকশা কেনার পরামর্শ দিয়ে তাঁকে সমিতি থেকে টাকা ঋণ দিলাম। তাঁকে ঋণের টাকা পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়া হলো এক বছরের মধ্যে। এভাবে এই সমিতির মাধ্যমে এলাকার অনেক লোকের কর্মসংস্থান ও আয়ের পথ বের করে দেই আমরা। রাতারাতি কিছু হয়ে যাব বা করে ফেলব, এমন চিন্তা নিয়ে আমি সমিতি গঠনের উদ্যোগ নিইনি। আমাদের সমিতি নিয়ে জকিগঞ্জের আশপাশের এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল জেগে উঠল। আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সমিতির মূলধন দিয়ে সদস্যরা কিস্তির মাধ্যমে পরিবহন, কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, সেলাই মেশিন কিনতে শুরু করলেন। আরম্ভ করলেন মাছ চাষ, গবাদিপশু পালন, নার্সারি গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজ। সমিতির কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ সদস্য হয়ে এখানে টাকা আমানত রাখা শুরু করেন। অফিসে কাজ বেড়ে যাওয়ার কারণে ৩০জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে হলো। সমিতির আয় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করা হলো। এভাবে এখন আমাদের মূলধন ১৪ কোটি টাকা। ৩ বার আমাদের সমিতি বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ট সমবায় পুরস্কার পায়। এই পুরস্কার আমাদের সমিতির কর্মকর্তা ও সদস্যদেরকে আরও উদ্বুদ্ধ করে তোলে। এখন আমাদের সদস্য সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার। আমরা নিত্য প্রয়োজনীয় আবাসন প্রকল্প, সমাজ ও জনকল্যাণ তহবিলসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু করি। প্রতিটি প্রকল্পই লাভজনক হয়ে ওঠে। জনকল্যাণ প্রকল্প হিসেবে আমরা বেকার যুবক/যুবতীদেরকে ফ্রি সেলাই প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার প্রশিক্ষন, মৎস্য, পোল্ট্রি, কৃষিচাষসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষন দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। জকিগঞ্জে কোন এম্বুল্যান্স না থাকায় আমরা সমিতির পক্ষ থেকে একটি এম্বুল্যান্স ক্রয় করেছি। এলাকার অসহায় মানুষের জন্য আমরা এম্বুল্যান্স সার্ভিস ফ্রি দিয়ে থাকি।
রাতারাতি কিছু হয়ে যাব বা করে ফেলব, এমন চিন্তা নিয়ে আমি সমিতি গঠনের উদ্যোগ নিইনি। অনেক চিন্তা ভাবনা করে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির মাধ্যমে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করেছি। সমিতির দায়িত্ব এর সদস্যদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করা। সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকার যেন কোনো অপচয় না হয়, সে ব্যাপারটি আমরা কঠোরভাবে দেখে থাকি। সদস্যরা লাভের জন্য এসে যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হন, সেটাই আমাদের প্রথম চিন্তা। যেকোনো পদক্ষেপ অথবা প্রকল্প গঠনের পর কঠোর তদারক করা হয়। লক্ষ রাখা হয়, যাতে কোনোভাবেই কোনো প্রকল্প লোকসানের মুখে না পড়ে।
প্রতি মাসের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতি মাসে শেষ করা হয়। ব্যবস্থাপনা থেকে শুর করে প্রতিটি প্রকল্প আলাদাভাবে হিসাবের মধ্যে এনে চূড়ান্ত জমা-খরচ, লাভ-ক্ষতির হিসাব উপজেলা সমবায় কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমবায় সমিতির সার্ভিস রুল অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এই সমিতির মাধ্যমে এরই মধ্যে হাজারো বেকার যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব মিলিয়ে ধরলে সমিতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩ হাজার লোকের। হাওর উন্নয়নে ৩শ কেদার জমি ক্রয় করা হয়েছে। এই জমি বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। আমাদের সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ২শ বেকার যুবক প্রবাসে গিয়েছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে সমবায় আন্দোলনে ভূমিকা রাখা, আরও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎপাদনমুখী কাজে নিয়োজিত হওয়া। সমিতিকে একটি মডেল হিসেবে গড়ে তোলা। যুবকদের প্রতি তিনি আহবান জানিয়ে বলেন, যুবক সম্প্রদায় দেশের প্রাণ। এদের মধ্যে তারুণ্য উদ্দীপনা ও কর্মচাঞ্চল্য বেশী। নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে ও দেশ মাতৃকার কল্যানে এবং সমাজের জনহিতকর কাজের জন্য আর্থিক বা সামাজিকভাবে কর্মউদ্যোগী হতে তিনি যুব সমাজের প্রতি আহবান জানান।
#copy:- barohalsobshomoy

SHARE THIS
Previous Post
Next Post