গতকাল যেখানে মেয়ে মিমকে হারিয়েছেন, আজ সেই রাস্তায় বসেই কাঁদছেন বাবা

সময়ের কণ্ঠস্বর- দিনদুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে নিজেদের কলেজের অদূরে বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন একঝাঁক শিক্ষার্থী।

জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার দিয়ে মিরপুর থেকে উত্তরাগামী গাড়িগুলো যেন উড়তে উড়তে আসছে। শিক্ষার্থীরা তাই দাঁড়িয়েছিলেন পাশের ঢাকা সেনানিবাসের দেয়ালঘেঁষে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।

দেয়ালে ঠেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের পিষে দিল দ্রুত ছুটে আসা জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দুই শিক্ষার্থী দিয়া খান মীম (১৭) ও আবদুল করিম রাজীব (১৭)।

নিহতদের মধ্যে দিয়া খান মিম বরিশালের জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে। সে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মেঝ মিম বাবা-মার সঙ্গে মহাখালী দক্ষিণ পাড়ায় থাকত।

প্রতিদিনের মতো গতকাল রোববারও একসঙ্গে সকালের নাস্তা করে মহাখালীতে মেয়েকে বিআরটিসি বাসে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসেন বাবা জাহাঙ্গীর আলম। এরপর একবার ফোন করে মেয়েকে বলেন, মা নিতে আসব? দিয়া বলেছিল, না বাবা তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমি নিজেই চলে আসতে পারব। আর ফেরা হল না দিয়ার। বাসচাপা পড়ল আমার আদরের দিয়া। শেষ হল আমার মেয়ের ম্যাজিস্ট্রেট বানানোর স্বপ্নও।’

সোমবার দুপুরে মেয়ের অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় বসে এভাবেই আহাজারি করছিলেন হতবাগা বাবা জাহাঙ্গীর আলম।

শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ছাত্রী মিমের মৃত্যুর খবর শুনে এদিন দুপুরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ছুটে আসেন বাবা জাহাঙ্গীর আলম। জরুরি বিভাগে মেয়ের মরদেহ দেখার পর হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মেয়ের মরদেহ দেখে কয়েকবার মূর্ছাও যান তিনি।

এসময় হাসপাতালে কথা হয় জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। জানান, তিনি নিজেও একজন বাসচালক। ঢাকা-রাজশাহী পথে ৩০ বছর ধরে দূরপাল্লার বাস চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, চালকেরা অদক্ষ, নেশাগ্রস্ত। বাসমালিকেরা যাকে-তাকে স্টিয়ারিংয়ে বসাচ্ছে।

জাহাঙ্গীর আলমের বলেন, এখন রাজনৈতিক বা অন্য প্রভাব খাটিয়ে ঢাকায় একটার পর একটা বাস কোম্পানি তৈরি হচ্ছে। বাসমালিকেরা আত্মীয়-পরিজন যাকে পাচ্ছে, তাকেই স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন।

এসব চালকের বেশির ভাগই নেশাগ্রস্ত। কেউ কেউ তো গাড়ি চলন্ত অবস্থায়ও গাঁজা খাচ্ছে। তাদের থামানোর জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান মিমের বাবা।

এদিকে  জানা যায়, শিক্ষার্থীদের চাপা দেওয়া বাস জাবালে নূরের (ঢাকা মেট্রো ব-১১৯২৯৭) পরিচালক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের শ্যালক মো. নান্নু মিয়া (৫০)। একই সঙ্গে তিনি মন্ত্রীর খালাতো ভাইও। থাকেন রাজধানীর বনশ্রী এলাকায়।

জাবালে নূর পরিবহনের সঙ্গে মাহমুদ হোসেন নামে নৌপরিবহনমন্ত্রীর আরেক আত্মীয়ও জড়িত আছেন বলে জানা গেছে।

বিআরটিএ’র তথ্যমতে, জাবালে নূর পরিবহনের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন। তিনি সরাসরি কোনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও মন্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। পরিবহনটি মো. নান্নু মিয়ার প্রভাবেই সড়কজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে পরিবহন জগতে প্রভাবশালী পরিচালক হিসেবেও নান্নু মিয়ার পরিচিতি আছে।

তবে এ বিষয়ে কথা বলতে জাবালে নুর কোম্পানির চেয়ারম্যান মো. জাকিরকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে এ দুর্ঘটনা বিষয়টি নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে প্রথমে হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। পরে সাংবাদিকদের তোপের মুখে নৌমন্ত্রী বলেন, ‘আমি শুধু এটুৃকু বলতে চাই, যে যতটুকু অপরাধ করবে সে সেভাবেই শাস্তি পাবে।’

SHARE THIS
Previous Post
Next Post