পৃথিবীর বুকে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা আল্লাহর কাছে মনোনীত। ইসলামই হচ্ছে পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলাম শুধু একটি ধর্মেরই নাম নয়; বরং এটি একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থাও বটে। তাই মানুষের জীবনের পরিধি যেমন ব্যাপক-বিস্তৃত তেমনি ইসলাম ধর্মের শাখা-প্রশাখাও ব্যাপক এবং বিস্তৃত। বহুসংখক শাখাবিশিষ্ট কোন একটি জিনিসের যে কোন একটি শাখা নিয়েই ব্যস্ত থাকলে যেমন সেটা পূর্ণ হয়না তেমনি ইসলাম ধর্মের কোন একটি শাখা নিয়েই ব্যস্ত থাকলে এতে পরিপূর্ণতা আসবেনা। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী সবকটি শাখাতেই অংশ নিতে হবে। অতএব, কোন বক্তা যদি মনে করেন, ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে তিনি ইসলামের পূর্ণ খেদমত করে যাচ্ছেন, কোন মাদরাসার শিক্ষক যদি মনে করেন, মাদরাসায় দরসদানের মাধ্যমে তিনি ইসলামের পূর্ণ খেদমত করে যাচ্ছেন, কোন ইমাম-মুয়াযযিন যদি মনে করেন; তিনি ইমামতি-মুআজ্জিনি করে ইসলামের পূর্ণ খেদমত করে যাচ্ছেন; তাহলে সেটা হবে তাদের ভূল ধারণা এবং ভূল বিশ্বাস। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত মুসলিম শরীফের এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ঈমানের ৭২টি শাখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হল “রাস্তা হতে কোন কষ্টদায়ক বস্তু সরানো। এক কথায় যাকে বলা যায় মানবসেবা। এই হাদীস থেকে বুঝা যায় মানব সেবাও ইসলাম ধর্মের একটি শাখা। পৃথিবীর প্রায় সবগুলো মানুষই কোন না কোনভাবে মানবসেবায় জড়িত। চায় সে মুসলমান হোক বা অন্য কোন ধর্মাবলম্বী হোক। তবে হ্যাঁ, সবার জড়ানোটা এক পর্যায়ের না। কারোরটা ব্যক্তি কেন্দ্রিক, কারোরটা গোষ্ঠি বা সমাজ-দেশ কেন্দ্রিক। মানবসেবায় যারা জড়িত তাদের সবার মাঝে এ কাজের প্রতি উদ্ভূদ্ধকারী হিসেবে যেই শক্তিটা কাজ করে সেটা হচ্ছে “মানবতাবোধ”। যার মাঝে মানবতাবোধ আছে সেই মানবসেবায় এগিয়ে আসে। কেহ যদি কাউকে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, কেউ যদি কাউকে ঠান্ডা শীতে কাপড়ের অভাবে কাঁপতে দেখে; কারো প্রতিবেশী যদি ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত্রিযাপন করে, কেহ যদি পথের কোন শিশুকে ক্ষুধার তাড়নায় কাতরাতে দেখে; আর সে যদি তার পাশে এসে না দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে মানবতার লেশমাত্রও নেই। যার মাঝে মানবতা আছে সে অবশ্যই অসহায়ের পাশে এসে দাঁড়াবে। তার সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসবে মানব সেবায়।
পৃথিবীটা এক আজব জায়গা। আজব তার বস্তুসমূহের প্রভাব। কুরআন ও হাদীসের ভাষা অনুযায়ী প্রত্যেকটা মানুষই নিষ্পাপ হয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশ-প্রতিক্রিয়ার কারণে তার সেই নিষ্পাপতা বাকী থাকেনা। চলে আসে তার জীবনে কলুষতা। বদলে যায় তার জীবন। নিষ্পাপ হয়ে জন্ম নিয়েও সে হয়ে যায় অপরাধ জগতের রাজা। হারিয়ে যায় জন্মগতভাবে পাওয়া তার মাঝে লুকিয়ে থাকা মানবতাবোধ নামের গুণটাকে। ইসলাম যেহেতু একটি পুর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, তাই মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রেখেছে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। সামাজিক জীবন সুস্থ-সুন্দর হওয়ার জন্য মানবতাবোধের কোন বিকল্প নেই। তাই মানবতা বোধ যেন কারো থেকে উধাও না হয়ে যায় সেদিকে ইসলাম রেখেছে পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি। আর একারনেই মানবসেবাকে ইসলাম শুধু মানবতার বিষয় হিসেবেই রাখেনি বরং একে উল্লেখ করেছে এক মহৎ এবং পূণ্যের কাজ হিসেবে। সাথে-সাথে নানানভাবে উৎসাহিত করেছে এই মানব সেবার প্রতি।
আল-কুরআনে মানব সেবা
আল্লাহ তাআলা বলেন “মহান প্রভূ কি আপনাকে এতীম হিসেবে পাননাই? তারপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন। [সূরা দোহা : ৬] এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সা. এর অসহায়ত্বের কথা এবং তাঁকে আশ্রয়দানের কথা উল্লেখ করেছেন।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন- “আর তারা তাদের খাবারের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে খাবার অসহায়, এতীম এবং বন্ধীদেরকে খাওয়ায়। [সূরা দাহার : ৮]
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা অসহায়, মিসকীন, বন্ধীদের খাবার দান করাকে মুমিনেদের বৈশিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কাফেরদের মন্দ স্বভাব বর্ণনা করে বলেন “কাফেরদের যে কয়টা মন্দ স্বভাব এগুলোর মধ্যে একটি হল, “আর সে মিসকীনকে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেনা। [সূরা মাউন : ৩]
অন্যত্র আল্লাহপাক ইরশাদ করেন “আর যারা কাফের তারা ঈমানদারদেরকে বলে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করলে খাবার দিতে পারে আমরা কি তাদেরকে খাবার খাওয়াব? [সূরা ইয়াসীন : ৪৭]
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তাআলা কাফেরদের মন্দস্বভাবের আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ অসহায়ের পাশে না দাঁড়ানো, তাদের খোজ-খবর না রাখা, মানব সেবায় এগিয়ে না আসা এটা কাফেরদের স্বভাব। পক্ষান্তরে মুমিনগণ মানবসেবায় থাকে সদা তৎপর।
নবী জীবনে মানব সেবা
হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘ঐ ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন না যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। [মুসতাদরাকে হাকেম, আদাবুল মুফরাদ]
হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত, হযরত জাবের রা.-এর পিতা উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। এবং তিনি ছয় কন্যা এবং অনেক ঋণ রেখে যান। তারপর যখন খেজুর কাটার মৌসুম আসল, তখন তিনি রাসূল সা. এর দরবারে গমন করেন এবং রাসূল সা. কে বলেন- হে আল্লাহর রাসূল সা.! আপনিতো জানেন যে আমার পিতা উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং তিনি অনেক ঋণ রেখে গেছেন। তাই আমি চাই যে, এব্যাপারে আপনি পাওনাদারদের কাছে সুপারিশ করবেন। তখন রাসূল সা. বললেন তুমি চলে যাও এবং তোমার যত খেজুর আছে সবগুলোকে একস্থানে স্তুপ কর। হযরত জাবের রা. বলেন আমি স্তুপ দিয়ে আল্লাহর রাসূল সা.-কে ডাকলাম। পাওনাদাররা যখন এই স্তুপ দেখল তখন তাদের ভাবটা এমন ছিল যে, তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। রাসূল সা. যখন তাদের এই অবস্থা দেখলেন, তখন বললেন তুমি তোমার পাওনাদারদের ডাক। তারপর রাসূল সা. তাদেরকে মেপে মেপে খেজুর দিতে লাগলেন। এমনকি এক পার্যায়ে আল্লাহ আমার পিতার ঋণ পারিশোধ করে দিলেন। অথচ আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট ছিলাম যে, আমার পিতার ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে আর আমার বোনদের জন্য একটি খেজুরও ফেরত নিবোনা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা পুরো স্তুপটাকেই রাখলেন যেন এই স্তুপ থেকে একটি খেজুরও কমে নাই। [সহীহ বুখারি শরীফ ২য় খন্ড পৃষ্ঠা : ৫৮০]
সাহাবিদের মানব সেবা
একবার হযরত ইবনে আব্বাস রা. মসজিদে নববীতে এতেকাফরত ছিলেন। এমন সময় একলোক তাঁর নিকট এসে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে পড়লেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বললেন, কি ব্যাপার তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুবই চিন্তিত এবং পেরেশান! জবাবে লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূলের চাচাত ভাই! নিশ্চয় আমি খুব চিন্তিত এবং পেরেশান। কেননা অমুক ব্যক্তির নিকট আমি ঋণী আছি। তারপর সে রাসূলের রওজা শরীফের দিকে ইশারা করে বলল, এই কবরওয়ালার ইজ্জতের কসম! এই ঋণ আদায় করার সামর্থ্য আমার নেই। ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমি কি তার নিকট তোমার জন্য সুপারিশ করব? লোকটি বলল আপনি যা ভাল মনে করেন। একথা শুনে হযরত! ইবনে আব্বাস রা. তৎক্ষণাৎ জুতা পরে মসজিদের বাহিরে আসলেন। লোকটি বলল হযরত আপনি কি এতেকাফের কথা ভূলে গেছেন? তিনি বললেন, না ভূলি নাই। তবে খুব বেশী দিনের কথা নয়, আমি এই কবরওয়ালার কাছ থেকে শুনেছি যে, (এই কথা বলার সময় ইবনে আব্বাসের চক্ষু দিয়ে অশ্র“ ঝরছিল) যে ব্যক্তি নিজে অন্য কোন মুসলমান ভাইয়ের কোন প্রয়োজনে চলাফেরা করবে এবং তার জন্য চেষ্টা করবে উহা তার জন্য দশ বছর এতেকাফ করার চাইতেও উত্তম হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন এতেকাফ করে আল্লাহপাক তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। যার দূরত্ব আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী দূরত্ব হতেও অধিক। (একদিনের এতেকাফের ফযিলতই যখন এরূপ তখন দশ বছর এতেকাফের ফযীলত কী পরিমাণ হবে?) [ফাযায়েলে আমালের সূত্রে তাবরানী বাইহাকী. হাকীম, তারগীব]
এই হাদীস দ্বারা দুটি বিষয় বুঝা যায়। ১. এতেকাফের ফযিলত, ২. যে বিষয়টি বুঝা যায় সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হল কোন মুসলমানের প্রয়োজন পূর্ণ করা। যাকে দশ বছরের এতেকাফের চেয়েও বেশি সওয়াবের কাজ বলা হয়েছে। কুরআন এবং হাদীসে আরো বহু আয়াত এবং হাদীস রয়েছে যা মানব সেবাকে সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই না বরং এর প্রতি উৎসাহিতও করে।
আশা করি সামান্য কয়েকটি আয়াত-হাদীস দ্বারাই পাঠকমহলে প্রমাণিত হয়েছে যে, মানবসেবাও ইসলামের শাখাসমূহের একটি শাখা। মানব সেবায় নিজেকে কোনভাবে নিয়োজিত করার মানেই হল প্রাকারান্তরে ধর্মের খেদমত করা। সুতরাং কেউ যদি ধর্মের খেদমত আর মানবসেবাকে দুচোখে দেখে, তাহলে বুঝতে হবে এটা তার দৃষ্টিসীমার সংকীর্ণতা। অতএব একথা বলার কোন সুযোগ নেই যে, ধর্ম আর মানবসেবা দুটি আলাদা-আলাদা বিষয়।
লক্ষ্যণীয় বিষয়
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, হযরত জাবের রা.এর হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. নিজে কাজ করে হযরত জাবের রা.এর প্রয়োজন পূরণ করছেন। আর হযরত ইবনে আব্বাস রা. ঐ ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করছেন। এতে লক্ষ্য করারমত বিষয় যেটি সেটি হচ্ছে আল্লাহর রাসূলের পক্ষে যেহেতু সম্ভব ছিল যে, তিনি নিজেই তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন তাই তিনি নিজেই সেটা করেছেন। আর হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর হয়তো এতটুকু ক্ষমতা তখন ছিলনা যে, তিনি নিজের পক্ষ হতে তার ঋণ শোধ করবেন তাই তার জন্য সুপারিশ করেছন।
আমাদের করণীয়
আমাদের জন্য করণীয় সেটাই যেটা উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বুঝে আসে, সামর্থ থাকলে অর্থবল দিয়ে মানুষের সেবা করব। আর সেটা না থাকলে অন্তত কথার মাধ্যমে চায় সেটা শান্তনার মাধ্যমেই হোক বা অন্য যে কোন উপায়ে হোক অসহায়ের পাশে দাঁড়াব। মোটকথা যেভাবেই হোক সবসময় নিজকে মানবসেবায় নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করব। কবি আব্দুল কাদের তার “মানুষের সেবা” নামক কবিতায় একথাটিই বলেছেন-
খোদা বলিবেন, হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধার অন্ন, তুমি করনাই দান।
মানুষ বলিবে, তুমি জগতের প্রভূ,
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে? সে কাজ কি হয় কভূ?
বলিবেন খোদা, ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে যদি খাওয়াইতে তারে।
পুনরায় খোদা বলিবেন, শোন হে আদম সন্তান,
পিপাসিত খোদা হয়ে গিয়েছিনু আমি করাওনি জলপান।
মানুষ বলিবে, তুমি জগতের স্বামী,
তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?
বলিবেন খোদা, তৃষ্ণার্ত তোমায় ডেকেছিল জল আশে,
তারে যদি জল দিতে তুমি, তবে পায়তে আমায় পাশে।
লেখক :
পৃথিবীটা এক আজব জায়গা। আজব তার বস্তুসমূহের প্রভাব। কুরআন ও হাদীসের ভাষা অনুযায়ী প্রত্যেকটা মানুষই নিষ্পাপ হয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশ-প্রতিক্রিয়ার কারণে তার সেই নিষ্পাপতা বাকী থাকেনা। চলে আসে তার জীবনে কলুষতা। বদলে যায় তার জীবন। নিষ্পাপ হয়ে জন্ম নিয়েও সে হয়ে যায় অপরাধ জগতের রাজা। হারিয়ে যায় জন্মগতভাবে পাওয়া তার মাঝে লুকিয়ে থাকা মানবতাবোধ নামের গুণটাকে। ইসলাম যেহেতু একটি পুর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, তাই মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রেখেছে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। সামাজিক জীবন সুস্থ-সুন্দর হওয়ার জন্য মানবতাবোধের কোন বিকল্প নেই। তাই মানবতা বোধ যেন কারো থেকে উধাও না হয়ে যায় সেদিকে ইসলাম রেখেছে পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি। আর একারনেই মানবসেবাকে ইসলাম শুধু মানবতার বিষয় হিসেবেই রাখেনি বরং একে উল্লেখ করেছে এক মহৎ এবং পূণ্যের কাজ হিসেবে। সাথে-সাথে নানানভাবে উৎসাহিত করেছে এই মানব সেবার প্রতি।
আল-কুরআনে মানব সেবা
আল্লাহ তাআলা বলেন “মহান প্রভূ কি আপনাকে এতীম হিসেবে পাননাই? তারপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন। [সূরা দোহা : ৬] এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সা. এর অসহায়ত্বের কথা এবং তাঁকে আশ্রয়দানের কথা উল্লেখ করেছেন।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন- “আর তারা তাদের খাবারের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সে খাবার অসহায়, এতীম এবং বন্ধীদেরকে খাওয়ায়। [সূরা দাহার : ৮]
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা অসহায়, মিসকীন, বন্ধীদের খাবার দান করাকে মুমিনেদের বৈশিষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কাফেরদের মন্দ স্বভাব বর্ণনা করে বলেন “কাফেরদের যে কয়টা মন্দ স্বভাব এগুলোর মধ্যে একটি হল, “আর সে মিসকীনকে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেনা। [সূরা মাউন : ৩]
অন্যত্র আল্লাহপাক ইরশাদ করেন “আর যারা কাফের তারা ঈমানদারদেরকে বলে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করলে খাবার দিতে পারে আমরা কি তাদেরকে খাবার খাওয়াব? [সূরা ইয়াসীন : ৪৭]
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তাআলা কাফেরদের মন্দস্বভাবের আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ অসহায়ের পাশে না দাঁড়ানো, তাদের খোজ-খবর না রাখা, মানব সেবায় এগিয়ে না আসা এটা কাফেরদের স্বভাব। পক্ষান্তরে মুমিনগণ মানবসেবায় থাকে সদা তৎপর।
নবী জীবনে মানব সেবা
হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘ঐ ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন না যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। [মুসতাদরাকে হাকেম, আদাবুল মুফরাদ]
হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত, হযরত জাবের রা.-এর পিতা উহুদের যুদ্ধে শহীদ হন। এবং তিনি ছয় কন্যা এবং অনেক ঋণ রেখে যান। তারপর যখন খেজুর কাটার মৌসুম আসল, তখন তিনি রাসূল সা. এর দরবারে গমন করেন এবং রাসূল সা. কে বলেন- হে আল্লাহর রাসূল সা.! আপনিতো জানেন যে আমার পিতা উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং তিনি অনেক ঋণ রেখে গেছেন। তাই আমি চাই যে, এব্যাপারে আপনি পাওনাদারদের কাছে সুপারিশ করবেন। তখন রাসূল সা. বললেন তুমি চলে যাও এবং তোমার যত খেজুর আছে সবগুলোকে একস্থানে স্তুপ কর। হযরত জাবের রা. বলেন আমি স্তুপ দিয়ে আল্লাহর রাসূল সা.-কে ডাকলাম। পাওনাদাররা যখন এই স্তুপ দেখল তখন তাদের ভাবটা এমন ছিল যে, তারা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। রাসূল সা. যখন তাদের এই অবস্থা দেখলেন, তখন বললেন তুমি তোমার পাওনাদারদের ডাক। তারপর রাসূল সা. তাদেরকে মেপে মেপে খেজুর দিতে লাগলেন। এমনকি এক পার্যায়ে আল্লাহ আমার পিতার ঋণ পারিশোধ করে দিলেন। অথচ আমি এতটুকুতেই সন্তুষ্ট ছিলাম যে, আমার পিতার ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে আর আমার বোনদের জন্য একটি খেজুরও ফেরত নিবোনা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা পুরো স্তুপটাকেই রাখলেন যেন এই স্তুপ থেকে একটি খেজুরও কমে নাই। [সহীহ বুখারি শরীফ ২য় খন্ড পৃষ্ঠা : ৫৮০]
সাহাবিদের মানব সেবা
একবার হযরত ইবনে আব্বাস রা. মসজিদে নববীতে এতেকাফরত ছিলেন। এমন সময় একলোক তাঁর নিকট এসে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে পড়লেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বললেন, কি ব্যাপার তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুবই চিন্তিত এবং পেরেশান! জবাবে লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূলের চাচাত ভাই! নিশ্চয় আমি খুব চিন্তিত এবং পেরেশান। কেননা অমুক ব্যক্তির নিকট আমি ঋণী আছি। তারপর সে রাসূলের রওজা শরীফের দিকে ইশারা করে বলল, এই কবরওয়ালার ইজ্জতের কসম! এই ঋণ আদায় করার সামর্থ্য আমার নেই। ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমি কি তার নিকট তোমার জন্য সুপারিশ করব? লোকটি বলল আপনি যা ভাল মনে করেন। একথা শুনে হযরত! ইবনে আব্বাস রা. তৎক্ষণাৎ জুতা পরে মসজিদের বাহিরে আসলেন। লোকটি বলল হযরত আপনি কি এতেকাফের কথা ভূলে গেছেন? তিনি বললেন, না ভূলি নাই। তবে খুব বেশী দিনের কথা নয়, আমি এই কবরওয়ালার কাছ থেকে শুনেছি যে, (এই কথা বলার সময় ইবনে আব্বাসের চক্ষু দিয়ে অশ্র“ ঝরছিল) যে ব্যক্তি নিজে অন্য কোন মুসলমান ভাইয়ের কোন প্রয়োজনে চলাফেরা করবে এবং তার জন্য চেষ্টা করবে উহা তার জন্য দশ বছর এতেকাফ করার চাইতেও উত্তম হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন এতেকাফ করে আল্লাহপাক তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। যার দূরত্ব আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী দূরত্ব হতেও অধিক। (একদিনের এতেকাফের ফযিলতই যখন এরূপ তখন দশ বছর এতেকাফের ফযীলত কী পরিমাণ হবে?) [ফাযায়েলে আমালের সূত্রে তাবরানী বাইহাকী. হাকীম, তারগীব]
এই হাদীস দ্বারা দুটি বিষয় বুঝা যায়। ১. এতেকাফের ফযিলত, ২. যে বিষয়টি বুঝা যায় সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হল কোন মুসলমানের প্রয়োজন পূর্ণ করা। যাকে দশ বছরের এতেকাফের চেয়েও বেশি সওয়াবের কাজ বলা হয়েছে। কুরআন এবং হাদীসে আরো বহু আয়াত এবং হাদীস রয়েছে যা মানব সেবাকে সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই না বরং এর প্রতি উৎসাহিতও করে।
আশা করি সামান্য কয়েকটি আয়াত-হাদীস দ্বারাই পাঠকমহলে প্রমাণিত হয়েছে যে, মানবসেবাও ইসলামের শাখাসমূহের একটি শাখা। মানব সেবায় নিজেকে কোনভাবে নিয়োজিত করার মানেই হল প্রাকারান্তরে ধর্মের খেদমত করা। সুতরাং কেউ যদি ধর্মের খেদমত আর মানবসেবাকে দুচোখে দেখে, তাহলে বুঝতে হবে এটা তার দৃষ্টিসীমার সংকীর্ণতা। অতএব একথা বলার কোন সুযোগ নেই যে, ধর্ম আর মানবসেবা দুটি আলাদা-আলাদা বিষয়।
লক্ষ্যণীয় বিষয়
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, হযরত জাবের রা.এর হাদীসে আল্লাহর রাসূল সা. নিজে কাজ করে হযরত জাবের রা.এর প্রয়োজন পূরণ করছেন। আর হযরত ইবনে আব্বাস রা. ঐ ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করছেন। এতে লক্ষ্য করারমত বিষয় যেটি সেটি হচ্ছে আল্লাহর রাসূলের পক্ষে যেহেতু সম্ভব ছিল যে, তিনি নিজেই তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন তাই তিনি নিজেই সেটা করেছেন। আর হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর হয়তো এতটুকু ক্ষমতা তখন ছিলনা যে, তিনি নিজের পক্ষ হতে তার ঋণ শোধ করবেন তাই তার জন্য সুপারিশ করেছন।
আমাদের করণীয়
আমাদের জন্য করণীয় সেটাই যেটা উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বুঝে আসে, সামর্থ থাকলে অর্থবল দিয়ে মানুষের সেবা করব। আর সেটা না থাকলে অন্তত কথার মাধ্যমে চায় সেটা শান্তনার মাধ্যমেই হোক বা অন্য যে কোন উপায়ে হোক অসহায়ের পাশে দাঁড়াব। মোটকথা যেভাবেই হোক সবসময় নিজকে মানবসেবায় নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করব। কবি আব্দুল কাদের তার “মানুষের সেবা” নামক কবিতায় একথাটিই বলেছেন-
খোদা বলিবেন, হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধার অন্ন, তুমি করনাই দান।
মানুষ বলিবে, তুমি জগতের প্রভূ,
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে? সে কাজ কি হয় কভূ?
বলিবেন খোদা, ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে যদি খাওয়াইতে তারে।
পুনরায় খোদা বলিবেন, শোন হে আদম সন্তান,
পিপাসিত খোদা হয়ে গিয়েছিনু আমি করাওনি জলপান।
মানুষ বলিবে, তুমি জগতের স্বামী,
তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?
বলিবেন খোদা, তৃষ্ণার্ত তোমায় ডেকেছিল জল আশে,
তারে যদি জল দিতে তুমি, তবে পায়তে আমায় পাশে।
লেখক :